বার্ধক্য জনিত সমস্যা
ফিজিওথেরাপি একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীকে পরীক্ষা করে, রোগ নির্ণয় করে, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রদান করেন এবং বিভিন্ন ফিজিক্যাল মেথডের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ, প্রতিকার, পুনর্বাসনসহ স্বাস্থ্যসেবার বিশাল অংশজুড়ে চিকিৎসা-পেশাজীবি হিসেবে কাজ করে।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা-পদ্ধতি হলো- ম্যানুয়াল থেরাপি, মাংসপেশির সঞ্চারণ বৃদ্ধি, অ্যাক্টিভ এক্সারসাইজ, ইলেক্ট্রোথেরাপি, ক্রায়োথেরাপি, টেপিং, ড্রাই নিডলিংসহ নানা প্রকার গবেষণালব্ধ চিকিৎসা যার মাধ্যমে ঔষধবিহীনভাবে ব্যথা, অক্ষমতা, পক্ষাঘাত অথবা সার্জারি ছাড়াই বহু সমস্যার আধুনিক চিকিৎসা করা হয়।
মানুষ আসলে জন্মের পর থেকেই বার্ধক্যের দিকে যেতে থাকে। কিন্তু, মানুষ বার্ধক্যে উপনীত না হলে এর সমস্যা ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু, আমাদের নিজেদের জন্য হলেও এটি সম্পর্কে ধারনা রাখাটা জরুরি।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বার্ধক্যের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে লাগলো। চিকিৎসা ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুহার হ্রাস, জীবনযাত্রার মানন্নোনয়ন- ইত্যাদির ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। বাংলাদেশেও যার ফলশ্রুতিতে গত ত্রিশ বছরে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ কোটি। ২০৫০ সালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা হবে ৯.৬ বিলিয়ন যার মধ্যে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা হবে ২ বিলিয়ন!
প্রবীণ ব্যক্তির এই সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রবীণ ব্যক্তিদের নানাবিধ সমস্যাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারন মানবদেহে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলো মূলত দুই প্রকার- মাস্কুলোস্কেলেটাল ও নিউরোলজিক্যাল। মোটা দাগে এগুলোকে ডিজেনেরেটিভ পরিবর্তন বলে।
মাস্কুলোস্কেলেটাল সমস্যার অর্থ হচ্ছে- মাংসপেশি ও হাড় সম্পর্কিত সমস্যা। বয়স্ক ব্যক্তিদের বিভিন্ন অস্থি সম্পর্কিত সমস্যা যেমন- অষ্টিও আরথ্রাইটিস, ফ্রাকচার, জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট, অষ্টিওপোরোসিস, স্পন্ডিলাইটিস ইত্যাদিতে ফিজিওথেরাপিস্টগণ সর্বাধিক ভূমিকা রাখতে পারেন। ব্যথা উপশম, মাংসপেশির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফিজিওথেরাপি সর্বাধিক কার্যকর।
অন্যদিকে প্রবীণ ব্যক্তিদের বিভিন্ন সফট টিস্যু সমস্যার মধ্যে রয়েছে ফ্রোজেন সোল্ডার, টেন্ডিনাইটিস, বার্সাইটিস প্রভৃতি। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার বিভিন্ন আডভান্স টেকনিক, যেমন- স্ট্রেচিং, স্ট্রেদেনিং, মাসেল রিহ্যাব প্রভৃতির মাধ্যমে একজন প্রবীণ ব্যক্তি তাঁর বয়সজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।
প্রবীণদের অন্যতম প্রধান আরেকটি শারীরিক সমস্যা হলো নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুবিক সমস্যা। এর মধ্যে প্রধান হলো- স্ট্রোক। পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ স্ট্রোক-জনিত বিকলাঙ্গতার শিকার হন। স্ট্রোক-পরবর্তী চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বর্তমানে বিভিন্ন আডভান্স ফিজিওথেরাপি টেকনিক, যেমন- বোবাথ, কার এন্ড শেফার্ড, পি এন এফ অ্যাপোচ ব্যবহার করা হচ্ছে। এইগুলো বিজ্ঞানসম্মত ও গবেষণালব্ধ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থা। স্ট্রোক ছাড়াও পারকিনসন্স ডিজিজ, এম এন ডি, এ্যটাক্সিয়া, নার্ভ ডিমায়ালিনাসনে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অত্যন্ত কার্যকর ও ফলপ্রসূ।
অবিসিটি বা স্থূলতা প্রবীণ ব্যক্তিদের একটি বহুল সমস্যা। স্থূলতা অন্যান্য রোগ ও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি স্থূলতা প্রশমনে ও শারীরিক ফিটনেস আনায়নে ফিজিওথেরাপির ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, মাংসপেশি ও জয়েন্টের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার ধরণ পরিবর্তনে প্রবীণ ব্যক্তিদের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কার্যকর বটে।
যেহেতু, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে ও প্রবীণ ব্যক্তিদের সমস্যার মাত্রা ও ধরণ পাল্টাচ্ছে; সুতরাং, এক বিশাল জনসংখ্যার ব্যথাহীন, সুস্থ ও সচলক্ষম জনগোষ্ঠী পেতে চাইলে এখন থেকেই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) বার্ধক্য বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবীণদের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, তাঁদের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়। একজন ফিজিওথেরাপিস্টই পারে ঔষধবিহীন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এক্সারসাইজ ও পরামর্শের মাধ্যমে একজন প্রবীণ ব্যক্তির সর্বোচ্চ কার্যক্ষমতা আনায়নে, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে। কারন সচল প্রবীণই প্রমাণ করতে পারেন- তার বয়সের সাথে প্রাণ জুড়ে গেছে!